প্রায় অর্ধ শতাধিক শিল্পী ও ক্যালিগ্রাফারদের শতাধিক শিল্পকর্ম নিয়ে ২৬ জানুয়ারি থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত জাতীয় জাদুঘর গ্যালারিতে চলমান প্রদর্শনীতে নতুন মুখের সমারোহ প্রশংসাযোগ্য। বাংলাদেশে পেইন্টিংয়ে ক্যালিগ্রাফি চর্চা ও একক প্রদর্শনি শুরু বর্ষিয়ান শিল্পী সাইফুল ইসলামের হাত ধরে। তবে সেটা কোন আন্দোলন বা শিল্প জাগরন ছিল না। শিল্প আন্দোলন হিসেবে প্রথম যিনি মাঠে নেমে পড়েন তার নাম শিল্পী কার্টুনিস্ট ইব্রাহীম মন্ডল। আমরা কয়েকজন তরুণ শিল্পী ও কবি তার সাথে হাত মিলিয়ে আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়ি। সেটা গত শতকের ৯০ দশকের কথা। আমরা বাংলাদেশ ক্যালিগ্রাফি সোসাইটি গঠন করে তরুনদের ক্যালিগ্রাফি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করি, ওয়ার্কশপ ও নিয়মিত জুমাবারের ক্যালিগ্রাফি ক্লাস ও প্রাণান্তকর শিল্পসাধনার প্রয়াস হচ্ছে আজকের এই জমজমাট প্রদর্শনির ভিত্তিভূমি। ৯০ দশক থেকে প্রায় ডজনখানেক জাতীয় ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনির আহবায়ক ছিলেন ইব্রাহীম মন্ডল আর আমি অধম এই প্রদর্শনিগুলোর আয়োজক কমিটিতে নগন্য খাদেম হয়ে থেকেছি। আমাদের মূল লক্ষ্য- ক্যালিগ্রাফি শিল্পকে তার মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফিকে বিশ্বের দরবারে নিজস্ব পরিচয়ে পুনরায় উপস্থাপন করা। আমরা জানি, সুলতানি বাংলার ক্যালিগ্রাফি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ও সুখ্যাতি লাভ করেছিল, আমাদের বেংগল তুগরা ও বাহরি শৈলি মিসরের ততকালিন মামলুক সুলতানদের এতটা আকর্ষণ করেছিল যে, তারা নিজেরা বেংগল তুগরায় ক্যালিগ্রাফি চর্চা শুরু করেন। কালের পরিক্রমায় আমাদের গৌরবময় এ শিল্প আবার আমাদের প্রজন্মকে আলোড়িত করেছে, বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ জনগোষ্ঠি এ শিল্পকে তাদের নিজেদের আত্মার তুষ্টি হিসেবে গ্রহণ করেছে।
মইনিয়া ফাউন্ডেশন ক্যালিগ্রাফি শিল্পকে প্রমোট করতে যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে তা প্রশংসাযোগ্য এবং সৈয়দ সাইফুদ্দীন সাহেবের একান্ত ইচ্ছা ও আগ্রহে ২০১৩ থেকে এ পর্যন্ত ১০টি আয়োজন সফলতার মুখ দেখেছে। এই আয়োজনে ইব্রাহীম মন্ডল ও আমি সর্বত সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছি কোন আভ্যন্তরিন বাধা উপেক্ষা করেই। আমাদের অনুজ প্রিয় সাইফুল্লাহ সাফাকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও দোয়া, সে অক্লান্ত পরিশ্রম করে শিল্পীদের জড়ো করেছে, বাস্তবতা হলো মইনিয়া ফাউন্ডেশনের এই আয়োজনে শিল্পীদের অংশ গ্রহন সাফার মাধ্যমেই হয়েছে, কারন শিল্পীরা মইনিয়া ফাউন্ডেশনের কারো পরিচিত নয়, এছাড়া এবার গ্যালারিতে এমন লোকও অভ্যর্থনায় বসেছে যিনি শিল্পীদের সাথে আলাপে সৌজন্যবোধটুকু রাখেন না, এটা খুবই স্পর্শকাতর বিষয়। ফাউন্ডেশন প্রধান সৈয়দ সাইফুদ্দীন সাহেব অত্যন্ত সজ্জ্বন ও মর্যাদাবান ব্যক্তি, আশা করি শিল্পীদের সম্মানের বিষয়টিতে উনার নজর রাখবেন।
এবারের প্রদর্শনিতে নবীন ও নতুন শিল্পীদের কাজ প্রাণবন্ত, তাদের কাজে সৃষ্টির উচ্ছাস চোখে পড়ার মত। ক্যালিগ্রাফিতে তাদের পথচলা শুরু হল, আশা করব তারা প্রত্যেকে নিজের আইডেন্টিটি দ্রুত করে নিবেন, প্রবীনদের কাছে দিকনির্দেশনা চাইবেন এবং যতদ্রুত সম্ভব অনুকরন ও কপি করা ছেড়ে নিজেকে ক্যালিগ্রাফার হিসেবে গড়ে তুলবেন, কেন খামখা নিজের পরিশ্রম সময় অর্থ ব্যয় করে আরেকজনের কামলা হিসেবে ভবিষ্যত নষ্ট করবেন। এ প্রদর্শনির তরুন ও প্রতিভাবান শিল্পীদের কাজ গুনে মানে দক্ষতার স্বাক্ষর বহন করে। শাকিলা চয়ন, সাদিয়াসহ বোনদের কাজ আমাদের আশান্বিত করেছে। তরুন উসামা, মুস্তাসিমসহ অনুজ ভাইদের কাজ আলোর পথে এগিয়ে যাবে, বাচ্চু ধর পালের ক্যালিগ্রাফি ক্রাফটটি ভাল লেগেছে। আমাদের বড়বোন ফেরদৌস আপা তার মেহেদি পাতার রস দিয়ে প্রায় অর্ধযুগের অক্লান্ত পরিশ্রমে কলকাতা শৈলিতে ক্যালিগ্রাফি ফর্মে কুরআন লেখার যে প্রয়াস চালিয়েছেন, তা তুলনাহীন। তার বিশেষত্ব মেহেদি পাতার রস দিয়ে ক্যালিগ্রাফি চিত্রাংকন। প্রদর্শনীতে আমার উস্তাদ ও এমফিল গবেষনার সম্মানিত সুপারভাইজার প্রাচ্যকলার প্রাণপুরুষ অধ্যাপক ড. আবদুস সাত্তার, ট্রাপেস্ট্রি মাধ্যমে অন্যতম প্রবীন শিল্পী তাজুল ইসলাম, শিল্পী সাইফুল ইসলামসহ কয়েকজন সিনিয়র আর্টিস্টের কাজ আছে। আমার বন্ধু আল মারুফ আর আমিন ভাইয়ের কাজ আধ্যাত্ম সাধনার মত। বন্ধু এমরুল নতুন দুটি কাজ দিয়েছেন তার নিজস্ব ফর্মে। আরিফ ভাই স্বভাবসুলভ পরিচ্ছন্ন আঙ্গিকে ফ্লাট ও জড়তাহীন রঙে ক্যালিগ্রাফি করেন, এটাই তাকে বিশিষ্টতা এনে দিয়েছে। প্রদর্শনিতে উপস্থাপিত তার কাজগুলো সেই ধারাবাহিকতা বহন করে। সংশ্লিষ্ট একটা বিষয় হল, বাংলাদেশে মসজিদ ক্যালিগ্রাফিতে মৌলিক কাজ এখন পর্যন্ত প্রধানত তিনজনের, টাইলস মাধ্যমে আমিনুল ইসলাম আমিন, চিনি টুকরা অর্থাত সিরামিক প্লেট ও কাচের টুকরা দিয়ে আরিফুর রহমান এবং মারবেল ইনলে ও ইনগ্রেভ মাধ্যমে আমি অধম আবদুর রহীম। একটা কথা বলতে হয়, মৃনাল হক টাইলস কেটে আরবি নকশা ও ক্যালিগ্রাফি দিয়ে অনেক কাজ করেছেন, এই প্রদর্শনিতে কয়েকটি ক্যালিগ্রাফি কাজ দিয়েছেন, যেগুলোর একটাও তার নিজের নয়, সব কপি করা। এর মধ্যে আমার উস্তাদ ও বন্ধু মরক্কোর বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফার বেন জাদ্দু আমেরের কাজের কপি আছে, কাজটিতে আমেরের সিগনচারও বাদ যায়নি।
এছাড়া সার্বিকভাবে প্রদর্শনি ভাল হয়েছে, অংশগ্রহনকারী শিল্পীদের আন্তরিক মোবারকবাদ জানাই, মইনিয়া ফাউন্ডেশনকে ধন্যবাদ, ক্যালিগ্রাফি শিল্প এগিয়ে যাক তার লক্ষ্যপানে, এই প্রত্যাশা সকলের।
Comments
Post a Comment