Skip to main content

ক্যালিগ্রাফির এক মহান উস্তাদ


১৯৯০ সালের প্রথম দিকের কথা। সম্ভবত এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ হবে। আমি বায়তুল মোকারমের নিচতলার মার্কেটে মার্বেল হাউজ নামের একটি দোকানে পাথরে ডিজাইনের কাজ করি। জোহরের সালাত আদায় করে এসে দেখি, ২’ বাই ৩’ একটি মার্বেল পাথরে চমৎকার আরবি ক্যালিগ্রাফিতে একটি মসজিদের নাম পেন্সিলে লেখা। সেটা খোদাই ও রঙ করে দিতে হবে। ক্যালিগ্রাফি দেখে এতই অভিভূত হলাম যে ক্যালিগ্রাফারকে তখনই দেখতে ইচ্ছে হল। বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটের অপর পাশে দারুল ফুনুন গেলে তাকে দেখতে পাওয়া যাবে। সব কাজ ফেলে সেখানে গেলাম। গিয়ে জানলাম তিনি আছর বাদ আসবেন কিংবা এসে আবার কোথাও কাজ থাকলে চলেও যেতে পারেন। সুতরাং দুপুরের খাওয়া ভুলে সেখানে বসে থাকলাম। আছর পড়ে দ্রুত আবার ফিরে আসলাম। কিছুক্ষণ পরে সাদা পাঞ্জাবি পাজামা পরা নুরানি চেহারার এক মাওলানা সাহেব এলেন। তাকে দেখেই মনে হল ইনিই ক্যালিগ্রাফির উস্তাদ। প্রথম দেখায়ই তাকে অনেক আপন মনে হল। পরিচয়ের পর খাবার আনালেন আর এত বিনয়ের সাথে কথা বললেন তাতে আমার খুব লজ্জা হচ্ছিল। সেই থেকে শুরু। একনিষ্ঠ সাগরেদ বনে গেলাম। সকালে খাতা কলম নিয়ে হাজির হই, সারাদিন দরস আর মশক। এভাবেই দিন গড়িয়ে গেল।
আমার মুহতারাম উস্তাদ শহীদুল্লাহ এফ. বারী শৈশবে পাকিস্তানে দীনি ইলম হাসিলের পাশাপাশি আরবি উর্দু খোশখত-এর প্রাথমিক শিক্ষালাভ করেন। এরপর সৌদি আরবে মদিনায় আর্ট ইনস্টিটিউট থেকে ক্যালিগ্রাফিতে ডিপ্লোমা লাভ করার জন্য ভর্তি হন। নানা প্রতিকুলতা ও অসুবিধা সত্ত্বেও এক বছর পর্যন্ত অত্যন্ত সফল ও মুমতায রেজাল্ট করেন। শিক্ষকগণ তাকে বিশেষ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সম্বর্ধনা প্রদান করেন। এ সময় ‘নাশখি’ শৈলিতে একটি কম্পিউটার ফন্ট তৈরি করেন, যেটা অনুমোদিত ও সৌদি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েব ফন্ট হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। সৌদি সরকার তার ভিসা নবায়ন না করায়, ডিপ্লোমা শেষ না করেই দেশে ফেরত আসেন। তবে ছয়টি গোলায়িত শৈলি সুলুস, নাশখ, দিউয়ানী, তালিক, রিকা ও মুহাক্কাক ক্যালিগ্রাফির ইযাযা, ফৌজি সালেম আফিফির কাছ থেকে লাভ করেন। বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফির একাডেমিক সনদ একমাত্র ও প্রথম তারই ছিল। পরে এ ছয়টি শৈলিতে উস্তাদ শহীদুল্লাহ এফ. বারীর কাছ থেকে ইযাযা সনদ একমাত্র এ নগন্য সাগরেদ মোহাম্মদ আবদুর রহীম লাভ করি। তিনি ছাত্রদের ভাল হাতের লেখা শেখার জন্য খত রুকাহ শৈলিতে একটি মুফরাদাত কাওয়ায়েদ রচনা করেন। ২০০৬ সালে সুলুস শৈলিতে তিনি এবং নাশখ শৈলিতে আমি মোহাম্মদ আবদুর রহীম এবং রঙের বিষয়ে ইব্রাহীম মন্ডল যৌথভাবে একটা হাতে-কলমে কিতাব রচনা করি। ঐ একই বছর নাশখ শৈলিতে অন্য একটি কিতাব আমি রচনা করি, উস্তাদ শহীদুল্লাহ এফ. বারী কিতাবটি অত্যন্ত যত্ন নিয়ে সংশোধন করে দেন এবং আমাকে দোয়া করেন। এরপর ২০০৯ সালে সুলুস লিপিতে একটি কাওয়ায়েদ রচনা করি এবং সেটিও তিনি যথাযথ পরামর্শ এবং একটি মূল্যবান অভিমত লিখে দেন। এই কিতাব রচনার জন্য তিনি বিশেষভাবে একরাতে তাঁর বাসায় দাওয়াত দেন এবং খানাপিনার পর হাদিয়াসহ দোয়া করেন।
উস্তাদের সাথে কয়েকটি দেশী ও বিদেশী ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনী ও প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছি। প্রতিবারই ক্যালিগ্রাফির শৈলি বিষয়ে তাঁর পরামর্শ ছিল আসমান সমান। ২০১৩ সালে ওআইসির কালচারাল বিভাগ ইরসিকা কর্তৃক প্রতিযোগিতায় পুরস্কার লাভ করায় তিনি অত্যন্ত খুশি হন এবং যথারীতি দাওয়াত দেন। তাঁর বাসায় গেলে খুশিতে জড়িয়ে ধরেন এবং আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। সেই দিন মনে হয় আমি তাঁর ক্যালিগ্রাফির ফায়েজ লাভ করি।
উস্তাদজি ছিলেন বাংলাদেশে আরবি ভাষা শিক্ষা প্রদানে এক উজ্জল নক্ষত্র। তাঁর ভাষা শিক্ষার ক্লাসে অংশ নিয়েছেন এমন বহু রত্ন দেশে বিদেশে ছড়িয়ে আছেন। এ বিষয়ে তিনি কয়েকটি কিতাব লিখেছেন। একদিন বিকেলে তিনি ফোন করে মোহাম্মদপুরের মারকাজে যেতে বললেন। আদেশ পাওয়া মাত্র মোটরবাইক নিয়ে রওনা হলাম। পথে প্রচন্ড ঝড়-বৃষ্টিতে ভিজে মারকাজে হাজির হলাম। তিনি আমাকে এ অবস্থায় দেখে দোয়া করলেন এবং তাঁর লেখা ভাষা শিক্ষার বইগুলো হাদিয়া দিলেন।
তিনি বাংলাদেশ সরকার এবং ওআইসির জন্য অনেক কিতাব আরবিতে অনুবাদ করে দিয়েছেন। তাঁর আরবি অনুবাদ এত উচ্চমানের ছিল, যা সৌদি বিশ্ববিদ্যালয় ফারেগ বহু প্রখ্যাত আলিম প্রশংসা করেছেন। তিনি আমৃত্যু সৌদি সামরিক এটাশে ঢাকার প্রধান অনুবাদক এবং খাত্তাত হিসেবে কর্মরত ছিলেন। উস্তাদের দোয়ার বরকতে আল্লাহপাক আমাকে সৌদি রিলিজিয়াস এটাশে ঢাকার খাত্তাত হিসেবে কবুল করেছেন।
উস্তাদের অনেক প্রত্যাশা ছিল দেশে একটি ক্যালিগ্রাফির ইনস্টিটিউট গড়ে উঠবে। ক্যালিগ্রাফি মিউজিয়াম, গ্যালারি ও আরকাইভ প্রতিষ্ঠিত হবে। তাঁর সেই স্বপ্ন আমরা সাগরেদকুল হৃদয়ে দৃঢ়ভাবে লালন করছি এবং চেষ্টা অব্যাহত রেখে চলেছি। ২০১৬ সালের ১৪ এপ্রিল ভোরে তিনি মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালায় ডাকে সাড়া দিয়ে ইন্তেকাল করেন। আল্লাহপাক তাঁকে জান্নাতের আ’লা মাকাম দান করুন। আমীন। - মোহাম্মদ আবদুর রহীম

Comments

Popular posts from this blog

বাংলা ক্যালিগ্রাফি : অনুভব ও শৈলী

-মোহাম্মদ আবদুর রহীম মানুষ জীবনযাপনে বাহ্যিক প্রয়োজন পূরণের পরও মানসিক আনন্দলাভ বা আত্মপিয়াস মেটাতে কিছু দেখতে, শুনতে কিংবা ছুয়ে দেখতে চায়। তার সংস্কৃতির মধ্যে নিজকে প্রকাশ করতে কিংবা সৃজনশীল কিছু করে আনন্দ পেতে চায় এবং অন্যকে আনন্দ দিতে তার ইচ্ছে জাগে। সুতরাং বলা যায়, কোন জাতির সংস্কৃতির মধ্যে যে সৃজনশীল ও প্রতিভার পরিচয় আমরা দেখতে পাই, সেটাই শিল্পকলা।শিল্পকলার অতি প্রাচীন একটি শাখা হচ্ছে ক্যালিগ্রাফি।ক্যালিগ্রাফি শব্দটা ইংরেজি । এটা গ্রীক শব্দ ক্যালিগ্রাফিয়া থেকে এসেছে । গ্রীক শব্দ ক্যালোস এবং গ্রাফেইনের মিলিত রূপ ক্যালিগ্রাফিয়া । ক্যালোস = সুন্দর , আর গ্রাফেইন = লেখা । সুতরাং   ক্যালিগ্রাফির পরিচয় এভাবে দেয়া যেতে পারে -   হরফ বা টেকসট ব্যবহার করে চমৎকার লেখন শিল্পকে ক্যালিগ্রাফি বলে । বর্তমানে , এই আর্ট ফর্মকে বিভিন্ন দেশ , ভাষা এবং ধর্মের লোকেরা আনন্দচিত্তে গ্রহণ এবং চর্চা করে চলেছেন । পৃথিবীতে বিভিন্ন ভাষার হরফে ক্যালিগ্রাফি করা হয়েছে। আরবি, ইংরেজি, চীনা, জাপানী প্রভৃতি ভাষার হরফের ক্যালিগ্রাফি মানুষকে মোহিত ও আনন্দিত

বাংলা ভূখন্ডে ক্যালিগ্রাফির পদযাত্রায় শিলালিপির ভূমিকা

Muhaqqaq style -মোহাম্মদ আবদুর রহীম ক্যালিগ্রাফিকে শুধুমাত্র 'হাতের লেখা' বলে পরিচয় দিলে অসম্পূর্ণ থেকে যায় এর অর্থ। 'সুন্দর হাতের লেখা' বললে আক্ষরিক অর্থ বলা হয়। আরব সিভিলাইজেশন প্রবন্ধে বলা হয়েছে- আরবি লিপিকলা প্রবহমান নকশা এবং জটিল জ্যামিতিক ডিজাইনের সমন্বয়। এই নান্দনিক লিপিকলা সম্পর্কে আলেকজান্দ্রিয়ার দার্শনিক ও গণিতের জনক ইউক্লিদ বলেন, "একটি 'আধ্যাত্মিক কৌশল' হিসেবে ক্যালিগ্রাফিকে গত ১৩শত বছর ধরে আরবদের কলম শুধু বিশুদ্ধ এবং সমৃদ্ধ করেছে।" আসলে ক্যালিগ্রাফি হচ্ছে লিপিকলা বা লিপি দিয়ে যে শিল্পকর্ম করা হয়। বাংলা ভূখন্ডে প্রাচীন কাল থেকে যারা শাসন করেছেন, তারা সুবিধামত একটি ভাষাকে রাজভাষা করেছেন এবং নথিপত্রে তা ব্যবহার করেছেন, জনসাধারণের সাথে সংযোগের ক্ষেত্রে এভাষায় জনহীতকর কাজের পরিচিতি ফলক বানিয়েছেন। প্রাচীনকাল থেকে এ অঞ্চলে পাথরে, তাম্র ফলকে এর নিদর্শন দেখা যায়। কাগজ বা টেকসইবিহীন মাধ্যমে এই নিদর্শন পাওয়া দুষ্কর। একটা মজার বিষয় হচ্ছে, ক্যালিগ্রাফির সত্যিকার পদযাত্রা নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে প্রাচীন নিদর্শন খুজতে গিয়ে ১২০৬ সালে (১

Sulus Lipisaili (khatt al-sulus) PDF book

   Sulus Lipisaili book PDF